নেপালে মাওবাদীদের নির্বাচনী বিজয়, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মিথ এবং কিছু জরুরী ভাবনা

নেপালে গত ১০ই এপ্রিল ২০০৮ এর নির্বাচনে মাওবাদীদের বিশাল ব্যবধানের বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম কোন মাওবাদী দলের নির্বাচনে জেতার রেকর্ড স্থাপিত হলো। সেই সাথে আমরা এই প্রথম কোন মাওবাদীদল সম্পর্কে দেশীবিদেশী পত্রপত্রিকায় সংবাদ ছাপা হতে দেখলাম যেখানে লেখা নেই- “মাওবাদীদের গেরিলা যুদ্ধের ফলে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যার অধিকাংশই নারী ও শিশু”। তার বদলে কর্পোরেট মিডিয়াওয়ালারা এখন জল্পনা-কল্পনায় ব্যাস্ত- কেমন করে নেপালে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি সহ দেশী বিদেশী বিভিন্ন্‌ এলিট রাজনৈতিক “হস্তরেখাবিদ”দের ভবিষ্যদ্বানী ব্যর্থ করে দিয়ে মাওবাদীদের এই ভূমিধ্বস বিজয় সম্ভব হলো! তারা আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছে মাওবাদীরা আবারও যেন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তাদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতে না পারে সেজন্যই জনগণ তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। আবার যেসব গোষ্ঠী জনগণকে এতটা বেওকুফ মনে করার মত বুদ্ধিমান(!) হয়ে উঠেনি, কিন্তু নেপালের জনগণ তাদের আড়াইশ বছরের রাজতন্ত্রের অবসানসহ একটি শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়েই মাওবাদীদেরকে ভোট দিয়েছে- এই স্বীকৃতিটুকু মাওবাদীদের দিয়ে ফেলার মত বেওকুফও নয়, তারা বলছে, আরে এসব কিছু না, এ হলো সঠিক রাজনৈতিক কৌশলের ফল; যেখানে যেই বর্ণ বা জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য, সে অঞ্চলে সেই বর্ণের বা জাতিগোষ্ঠীর প্রার্থী দিয়ে কিংবা প্রায় ৬০ ভাগ তরুণ জনসংখ্যার নেপালে ৫০ ভাগেরও বেশী আসনে প্রাথী হিসাবে তরুনদের দাঁড় করিয়ে — মাওবাদীরা আজকের এই বিজয় অর্জন করেছে!

অন্যদিকে এইসব আজগুবি, হাস্যকর এবং হীনউদ্দেশ্যমূলক প্রচার-প্রচারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ নেপালের মাওবাদীদের এই ঐতিহাসিক বিজয়কে নেপালের জনসাধারণের জন্য “একধাপ অগ্রগতি” হিসাবে চিহ্নিত করে অকৃত্রিম উচ্ছাস প্রকাশ করছে। সেই সাথে প্রাথমিক উচ্ছাসটুকু কেটে যাওয়ার পর, সকলেই এক তীব্র উৎকণ্ঠা, কৌতুহল কিংবা আশংকা নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে- পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে সাম্রজ্যবাদী ভারত এবং উত্তরে সাম্রজ্যবাদী চীন পরিবেষ্টিত নেপালের নতুন কান্ডারী মাওবাদীদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি; তারা কি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সিপিএম মার্কা পুঁজিবাদী উন্নয়নের দিকে যাবে নাকি ল্যাটিন আমেরিকায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ভেনিজুয়েলা কিংবা বলিভিয়ার মতো এক ব্যাপক বৈপ্লবিক রূপান্তরের সূচনা করবে?

মাওবাদীরা কোন পথে যাচ্ছেঃ
নেপালে রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অবসানের পর যে নতুন প্রজাতন্ত্রের সংবিধান নবনির্বাচিত সরকার রচনা করবে, সে প্রজাতন্ত্রের অর্থনীতি কোন ধরনের হবে? বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা(যেমনঃ নেপালি কংগ্রেস) চাইবে অর্থনীতির পুঁজিবাদী ধারাকে অক্ষুণ্য রাখতে, তাকে আরও গভীর করতে। অন্যদিকে মাওবাদীদের কাছে মুক্তিকামী জনগণের প্রত্যাশা, সকল শোষণ ও বৈষম্যের অবসানের প্রয়োজনে তারা অর্থনীতিকে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে নেবে। মাওবাদীরা মনে করে নেপালে সমাজতন্ত্রের জন্য বিপ্লব দুটি স্তরে বিভক্তঃ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব; বর্তমানে যা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তরে রয়েছে। ফলে মাওবাদীরা নেপালের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে অক্ষম বুর্জোয়াদের অসমাপ্ত বিপ্লব সম্পন্ন করে তারপর সমাজতন্ত্রের দিকে যাবে। মাওবাদীদের দ্বিতীয় প্রধান নেতা এবং নেপালের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ডঃ বাবুরাম ভট্টরাই ১৬ই এপ্রিল, ২০০৮ তারিখে “নেপালি টাইমস” পত্রিকার কাছে দেয়া এক স্বাক্ষাতকারে বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেনঃ

“যখন আমরা সামন্ততন্ত্রের অবসান চাই, তখন কিন্তু এটা বোঝাই না যে, আমরা ব্যক্তিমালিকানার অবসান চাই। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি এখন আমাদের ভাষায় ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ অর্থাৎ সমবায়ীকরণ, সামাজিকীকরণ এবং জাতীয়করণ এখন আমাদের এজেন্ডা নয়”।

এর আগে L’espresso পত্রিকার Alessandro Gilioli এর কাছে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাওবাদীদের প্রধান নেতা কমরেড প্রচন্ড একই ধরনের কথাই বলেছেনঃ

“উদারীকরণের যে প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে চলছে আমরা তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারিনা। সুতরাং আমরা আমাদের দেশে মিশ্র অর্থনীতির প্রয়োগ ঘটাবো। এই মুহূর্তে আমরা বলছিনা যে আমরা পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক একটি অর্থনীতির পরিকল্পনা করছি, তবু আমরা পশ্চিমা উদারীকরণকে অন্ধভাবে অনুসরণ করব না। আমাদের কিছু জাতীয় অগ্রাধিকার রয়েছে এবং আমরা নেপালের উন্নয়ন ঘটাবে এমন বৈদেশিক বিনিয়োগকে স্বাগতম জানাব”।

মাওবাদীরা মনে করছে নতুন সংবিধান রচনার মধ্যদিয়ে বিপ্লবের রাজনৈতিক দিকটি সমাপ্ত হবে। এরপর প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে পুঁজিবাদী পথে। মাওবাদীরা নির্বাচনে জেতার পরপরই যখন পুঁজিবাজারে অস্থিরতা শুরু হয় এবং ব্যাবসায়ী শ্রেণী আতংকিতবোধ করতে শুরু করে, মাওবাদীরা তখন তাদের আশ্বস্ত করেঃ

“আমরা প্রত্যেককে আশ্বস্ত করতে চাই, মাওবাদীরা আসার (সরকারে) পর বিনিয়োগের পরিবেশ আরো অনুকুল হবে। এ নিয়ে কোন ভুল বুঝাবুঝির সুযোগ নেই। পত্রপত্রিকায় আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে গুজব, তা ভুল। পুঁজি চলে যাওয়ার খবরও পাওয়া যা‌চ্ছে। কিন্তু এটা ঘটারও কোন প্রয়োজন নেই। আরেকটা বিষয় হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগের পরিবেশ আরো ভালো হবে”। 

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য করে তারা বলেনঃ

“ইতোমধ্যেই নেপালে এসেছেন এমন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের পুরোপুরি আশ্বস্ত করে বলছি, আমরা আপনাদের নেপালে স্বাগতম জানাই, আর বিনিয়োগের পরিবেশ আমরা আগের চেয়েও ভালো করে তুলবো। দেখবেন, আমরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা কেমন ভালো হয়। গত দুই বছরে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো যা করেছে তা রূপান্তরের পর্যায় বলে ঘটেছে …”

এখন নেপালের মাওবাদীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে, শ্রমিক-ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করে কিংবা বিগত দুই বছরের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আন্দোলনকে ‘রূপান্তর পর্যায়ের ফল’ বলে আখ্যায়িত করে বেসরকারী এবং বিদেশী বিনিয়োগের অনুকুল পরিবেশ তৈরী এবং তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে কথাগুলো বলছেন, তার মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার যে মাওবাদীরা তাদের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বুর্জোয়াদের মত করেই সম্পন্ন করতে চাচ্ছে! সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, বুর্জোয়াদের অসমাপ্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব যখন সমাজতন্ত্রীদের উপর বর্তায়, সমাজতন্ত্রীরা তা কেমন করে সম্পন্ন করবে- তারা কি বাবুরাম ভট্টরাই এর ভাষায় ‘জাতীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ’ ঘটাবে নাকি বাবুরাম যেটি অস্বীকার করেছেন সেই ‘সমবায়ীকরণ, সামাজিকীকরণ এবং জাতীয়করণ’ এর মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে?

রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের (ফেব্রুয়ারি বিপ্লব) সময় যখন সমাজতন্ত্রীদের সামনে এই প্রশ্নটি চলে আসে, মেনশেভিকদের তখন অবস্থান ছিল ‘বুর্জোয়া অর্থনীতির পূর্ণবিকাশের’ পক্ষে। ফেব্রুয়ারী বিপ্লব রাশিয়ায় দ্বৈত ক্ষমতার জন্ম দিয়েছিল- একদিকে প্রাদেশিক সরকারগুলোতে বুর্জোয়াশ্রেণীর আধিপত্য অন্যদিকে স্থানীয় ও অঞ্চলভিত্তিক সোভিয়েতগুলোতে (শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাউন্সিল) শ্রমিক-কৃষকের শক্ত অবস্থান। মেনশিভিকরা মনে করেছিল যেহেতু বিপ্লবের স্তরটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক, সেহেতু তখন সোভিয়েতগুলোর কাজ হবে প্রাদেশিক বুর্জোয়া সরকারগুলোকে পেছন থেকে সহায়তা দিয়ে যাওয়া। বিষয়টি বলশেভিকদের মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরী করে। লেনিন তখন ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে তার বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস‘ এর মাধ্যমে ঘোষণা করেন শক্তির কেন্দ্র হিসাবে সোভিয়েতগুলোতে শ্রমিকের ক্ষমতা সংহত করার মধ্যদিয়েই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটবে, এরপর শুরু করতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ব্যাপারে লেনিনের যে তাগাদা ছিল তার কোথাও তিনি পুঁজিবাদী পথে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেননি। তাছাড়া ব্যাপারটি এরকম নয় যে, ১৯১৭ সালের ফেব্রূয়ারি থেকে অক্টোবর – এই সাত মাসের মধ্যে জারতন্ত্র থেকে সদ্যমুক্ত রাশিয়ার পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে যায়, যার ফলে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাত্র সাত মাসের মাথায় বলশেভিকরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে প্রবেশ করে! কাজেই বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ রূপে সম্পন্ন হলেই কেবল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে যাওয়া যাবে ব্যাপারটি এরকম নয়। অক্টোবর বিপ্লবের ২ বছর পর, ১৯১৯ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনিন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময়ের মাঝে কোন সুস্পষ্ট ভেদরেখা টেনে দেননি বরং তিনি বলেছেন এদের মাঝে কোন চীনের গ্রেট ওয়াল নেই যে এদেরকে সুস্পষ্ট পর্যায়ে ভাগ করা যাবে। যে কারণে তিনি বলছেনঃ

যদি গ্রামের দিকের কথা ধরি তাহলে বলতে হয় আমাদের বিপ্লব তখনও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক পর্যায়েই ছিলো। পরে, কেবল মাত্র (অক্টোবর বিপ্লবের) ছয় মাস পর, আমরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে গ্রামের দিকে শ্রেণী সংগ্রাম শুরু করতে সক্ষম হই….” ।

অর্থাৎ গ্রাম পর্যায়ে বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সারা রাশিয়াব্যাপি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সে বুর্জোয়া বিপ্লবের কর্মসূচী যদি সমাজতন্ত্রের দিকে না ঝুঁকে, বুর্জোয়া বিকাশের দিকে ঝুঁকে থাকতো তাহলে কোন কোন স্থানে বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন করার আগেই সারা রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করা যেত না। তাই বুর্জোয়া বিপ্লবের কর্মসূচীগুলো এমন হতে হবে যেন তা দ্রুত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরিত হতে পারে।

এ বিষয়গুলো যে নেপালের মাওবাদীরা জানেনা এরকম নয়। কিন্তু তারা মনে করেন বিশ শতকের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর একুশ শতকের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এক রকম হবেনা। কিন্তু একুশ শতকের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় ঠিক কি গুণগত পরিবর্তন ঘটলো যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিদেশী বিনিয়োগ ও জাতীয় উদ্যোক্তা শ্রেণী অপরিহার্য হয়ে উঠলো, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মিথ
ধ্রুপদী অর্থে ধরে নেয়া হয় উৎপাদনে সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের পূর্ণ উচ্ছেদে জাতীয় বুর্জোয়ারা প্রধান ভূমিকা না হোক, অন্তত সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সময় মার্কসবাদীরা এর ভিত্তিতেই আশাবাদ পোষণ করে যে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোন লড়াইয়ে বুর্জোয়ারা হবে স্বাভাবিক মিত্র (ন্যাচারাল অ্যালি)। সবশেষে আশাবাদ পোষণ করা হয় যে এই শ্রেণীটি সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হবে- এক্ষেত্রেও কারণ সেই একই, পুঁজির বিকাশের জন্য স্থানীয় বাজারের উপর এদের নির্ভরশীলতা। এর মাধ্যমে জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য করা হয়, যেহেতু মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা বিদেশী কোম্পানী বা অর্থনীতির সাথে যুক্ত, ফলে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধা থাকে। যদিও লেনিন জাতীয় বুর্জোয়াদের সম্পর্কে সাবধান করে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের ২য় কংগ্রেসে বলেছিলেনঃ

শোষণকারী দেশের বুর্জোয়া এবং উপনিবেশের বুর্জোয়াদের মাঝে একটা নিশ্চিত মিল আছে, যেকারনে প্রায়শই- সম্ভবত সবসময়ই-শোষিত দেশের বুর্জোয়ারা যখন জাতীয় বিপ্লবকে সমর্থন করে, তখনও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে একমত থাকে এবং বিপ্লবী শ্রেণী এবং বিপ্লবী আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে জোট বাঁধে। কমিশনের সামনে এটা অভ্রান্ত ভাবেই প্রমাণিত হয়েছে, যেকারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে সঠিক বিচার করতে হলে, প্রায় সবক্ষেত্রেই, ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক’ শব্দটিকে ‘জাতীয় বিপ্লবী’ শব্দটি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। এই পরিবর্তনের বিশেষত্ব হলো এই যে, আমরা, কমিউনিষ্টরা উপনিবেশগুলোতে বুর্জোয়া স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করবো শুধুমাত্র তখনই, যখন তা সত্যিকার অর্থেই বিপ্লবী হবে এবং এর কোন একটি অংশ শোষিত ও কৃষক শ্রেণীর বিপ্লবী চেতনাকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করে তোলার জন্য আমাদের যে কাজ, তার বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। যদি এই শর্তগুলো বজায় না থাকে তবে সেই দেশের কমিউনিষ্টদের উচিত হবে সেই সংস্কারপন্থী বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা… ” 

বিগত কয়েক দশকের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনে আমরা দেখেছি জাতীয় বুর্জোয়ারা সামন্তশ্রেণীকে আঘাত করার দিকে খুব কমই আগ্রহ দেখিয়েছে। তার উপর, জাতীয় বুর্জোয়া আর মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার স্বতন্ত্র্য অস্তিত্বের ধারণাটিও প্রশ্নের সম্মুখীন। সন্দেহ নেই বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর সাথে সম্পর্কের ধরন অনুসারে এদের স্বার্থের ভিন্নতা রয়েছে কিন্তু বুর্জোয়াশ্রেণী একদিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার সংরক্ষণের চেষ্টা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের ভাগ পাওয়ার জন্য বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর সাথে সম্পর্ক ধরে রাখা- সুখের সাথে এই দুই ভূমিকা একত্রে পালন করতেই ব্যস্ত থেকেছে।

অন্যদিকে বেসরকারী পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে অনুন্নত দেশের উন্নয়ণের চেষ্টার পরিণতি দাঁড়িয়েছে- বিপুল পরিমাণ জাতীয় সম্পদ স্থানীয় বুর্জোয়াদের পকেটে চলে যাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে দেশগুলোর শিল্পনীতিগুলোতে একটা প্রকাশ্য চুক্তি ছিলো যে, ক্ষুদ্র মেয়াদে ভর্তুকি, অনুদান, স্বল্পসুদে ঋণ, ট্যাক্স মওকুফ ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে বেসরকারী ফার্মগুলোকে পাবলিক ফান্ড সরবরাহ করা হবে, বিনিময়ে রাষ্ট্র তাদেরকে জনগণের কল্যাণের প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যেন মধ্যমেয়াদে পুরো সমাজ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এভাবে বিকশিত হওয়া ‘জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী’টি থেকে উপকৃত হতে পারে। কিন্তু বুর্জোয়ারা স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মুনাফার স্বার্থে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রকে দুর্বলকরে রাখে এবং ফলত তারা গত অর্ধশতক ধরে এক দীর্ঘ ‘পুঁজির প্রাথমিক সঞ্চয়ন’ উপভোগ করে, তাদের ঝুঁকি এবং ক্ষতি উভয়েরই সামাজিকীকরণ করে কিন্তু মুনাফাটা ভোগ করে একতরফা ভাবে। তার শেষ পরিণতি দাঁড়ায় এরকম যে, একরকম শিল্প উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি হয়তো ঘটেছে, কিন্তু তা হয়েছে জনগণের চরম ক্ষতির বিনিময়ে।

আর বিশ শতকের তুলনায় একুশ শতকে ফাইনান্স পুঁজির বিশ্বায়ন ধ্রুপদী অর্থে জাতীয় বুর্জোয়া বলতে যে শ্রেণীটিকে বোঝায়, যারা একধরনের জাতীয়তাবাদের চেতনা ধারন করে জাতীয় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদের সাথে বিরোধে যেতেও দ্বিধা করে না, তার অস্তিত্বকে আরও অসম্ভব এবং অলীক করে তুলেছে। এখন কোন কারখানার পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও জ্বালানীর নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ, পণ্য উৎপাদনের প্রযুক্তি এবং উৎপাদিত পণ্যের বিশ্ব বাজারে বিক্রয় নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি নানা কারনে দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণী বিদেশী বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণীর উপর আগের চেয়ে অনেক বেশী নির্ভরশীল হতে বাধ্য। ফলে তার মুনাফা নিশ্চিত করার প্রয়োজনেই তাকে সাম্রাজ্যবাদীদের লেজুড় হিসাবে কাজ করতে হয়। জাতীয় বুর্জোয়ার বদলে এদেরকে বরং অভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া বলাই সঠিক হবে কেননা এদের কাছে জাতীয় স্বার্থ নয়, মুনাফাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মুনাফা নিয়ে সংঘাত দেখা দিলে, এরা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে ভয় দেখিয়ে মুনাফার ভাগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনে কখনও কখনও জাতীয় স্বার্থের প্রতি কৃত্রিম দরদ দেখিয়ে বামপন্থীদের সাথে সামাজ্রবাদবিরোধিতায় সায় দিলেও সাম্রাজ্যবাদীরা মুনাফার আশ্বাস দিলেই এরা বামদের পরিত্যাগ করে সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধে।

এসকল কারনেই আমরা মনেকরি বর্তমান শতকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুর্জোয়া এবং বুর্জোয়া অর্থনীতির বিকাশ সম্পর্কে বিশশতকের ঐতিহাসিক শিক্ষা একুশ শতকে এসে আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। তাই আমরা মনে করি নেপালের মতো ‌একটি পশ্চাতপদ, আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-উপনিবেশিক দেশে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে তার রাজনৈতিক এজেন্ডা হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো ও শাসন ব্যবস্থা তৈরী করা আর অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলো হবে এমন যেন তা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যায়। এই অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো সরাসরি সমাজতান্ত্রিক রুপান্তর না ঘটালেও তা সেই রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় একটি কাঠামো তৈরী করবে। এই পদক্ষেপগুলো কেমন হতে পারে সে বিষয়ে লেনিন তার এপ্রিল থিসিসে বলেছিলেনঃ

আমাদের এই মুহূর্তের কাজ সমাজতন্ত্রের ‘সূচনা’ ঘটানো নয় বরং সামাজিক উৎপাদন এবং উৎপাদনের ফলাফলের বণ্টনব্যবস্থাকে সোভিয়েতগুলোর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।” 

এ লক্ষে তিনি যে এজেন্ডাগুলো দিয়েছিলেন, সেগুলোর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলোঃ
*সোভিয়েতগুলোতে শ্রমিক-কৃষকের ক্ষমতা সংহত করা এবং প্রাদেশিক বুর্জোয়া সরকারকে কোন ধরনের সহযোগীতা না করে বরং উৎখাত করার চেষ্টা করা।
*বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি, এষ্টেট ইত্যাদির জাতীয়করণ।
*ব্যংকসমূহের জাতীয়করণ।
*কলকারখানায় শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
*পুরোনো আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর প্রশাসন তৈরী করা ইত্যাদি।

এ বিবেচনায় নেপালের মাওবাদীদের কমসূচী হতে পারতোঃ
*রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাজতন্ত্রীদের নিরঙ্কুশ প্রাধান্যর জন্যে শুধুমাত্র বামপন্থীদের সাথে কোয়ালিশান গঠন
*ভূমিব্যবস্থার বৈপ্লবিক সংস্কার
*বেসরকারী এবং বিদেশী ব্যাংকের জাতীয়করণ
*ভারতীয় বুর্জোয়া এবং তাদের স্থানীয় সহযোগীদের মালিকানায় থাকা কলকারখানা জাতীয়করণ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন ইত্যাদি।

বাস্তবে শুধুমাত্র ভূমিসংস্কার ছাড়া আর সবগুলো বিষয়েই তারা উল্টো হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন। শিল্প ও কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের বদলে বেসরকারী এবং বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানালেন। আর এর মাধ্যমে মাওবাদী নেতা প্রচন্ড আশা প্রকাশ করছেন যে আগামী ২০ বছরের মধ্যে তারা নেপালকে সুইজারল্যান্ডের মতো সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করবেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারী খাতের বিকাশ ঘটলে, তাতে মালিক পুঁজিপতি ফুলে ফেঁপে উঠবেন, শ্রমিক শ্রেণীর তো তাতে কিছু যাবে আসবে না। বরং রাষ্ট্রীয় কলকারখানায় শ্রমিক শ্রেণীর দাবি-দাওয়া ও কল্যাণ অনেক বেশী নিশ্চিত থাকে যেহেতু কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ব্যক্তি পুঁজিপতির পকেটে না গিয়ে রাষ্ট্রের শ্রমিক-কল্যাণ তহবিলে জমা হয় এবং রাষ্ট্র তা শ্রমিকের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি কাজে ব্যয় করতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগও একই ভাবে স্থানীয় কাঁচামাল ও সস্তা শ্রম শোষণ করে অর্জিত প্রভুত মুনাফা অল্পকিছু ট্যাক্সের বিনিময়ে বিদেশে পাচার করে। ফলে এক্ষেত্রেও শ্রমিক তার শ্রমের ফসল থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আর যাই হোক লেনিন কথিত সেই “উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদনের ফলাফলের উপর শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ” প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাজেই মাওবাদীদের এসব পদক্ষেপ পুঁজিবাদকে আরও গভীর করবে যার ফলশ্রুতিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব স্রেফ একটা বুর্জোয়া বিপ্লবে পরিণত হবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সুদুর পরাহতই থেকে যাবে।